হিন্দু ধর্মশাস্ত্র একাধিক। শ্রুতি দুপ্রকার—বেদ এবং তন্ত্র। এর পাশাপাশি রয়েছে বেদাঙ্গ, উপবেদ, ষড়-দর্শন, নীতিশাস্ত্র। রয়েছে পুরাণ। আর রয়েছে ইতিহাস—রামায়ণ এবং মহাভারত। প্রাচীন ভারতবর্ষের দুটি বিখ্যাত রাজবংশ—সূর্যবংশ এবং চন্দ্রবংশের কাহিনী বর্ণিত রয়েছে ইতিহাসে। মহাভারতে রয়েছে চন্দ্রবংশের বিবরণ। বৈদিকযুগের ঠিক পরপরই মহাভারতের সময়কাল, যা আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দ। এই মহাভারতেরই অংশ হল ভগবদ্ গীতা।
মহাভারতের মোট ১৮টি পর্ব রয়েছে। এর মধ্যে ষষ্ঠ পর্ব অর্থাৎ ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত হচ্ছে ভগবদ্ গীতা। ভীষ্মপর্বে মোট ১২৪টি অধ্যায় রয়েছে। সুবিধের জন্য এগুলিকে চারটি পর্বাধ্যায়ে ভাগ করা হয়, যেগুলি হল জম্বুখণ্ডবিনির্মাণ পর্বাধ্যায়, ভূমি পর্বাধ্যায়, ভগবদ্গীতা পর্বাধ্যায় এবং ভীষ্মবধ পর্বাধ্যায়। ভগবদ্গীতা পর্বাধ্যায়ে রয়েছে ১৩তম থেকে ৪২তম অধ্যায়। এরমধ্যে ভগবদ্ গীতা হল ২৫তম অধ্যায় থেকে ৪২তম অধ্যায়, অর্থাৎ মোট আঠারোটি অধ্যায়।
ভগবদ্ গীতা শ্রীকৃষ্ণ এবং অর্জুনের মধ্যে কথোপকথন। কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগে অর্জুন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। যুদ্ধ করা উচিত হবে কি না সেটা সেই মুহূর্তে তিনি বুঝে উঠতে পারছিলেন না। কোনটা ধর্ম আর কোনটা অধর্ম তা নির্ণয় করতে পারছিলেন না; তার কি কর্তব্য তা নির্ধারণ করতে পারছিলেন না। তখন পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ তাকে যে উপদেশ দেন তাই হলো গীতা। গীতা পাঁচহাজার বছর আগে যতখানি প্রাসঙ্গিক ছিল, আজও ঠিক ততটাই প্রাসঙ্গিক, এবং ভবিষ্যতেও সমান প্রাসঙ্গিক থাকবে। তার কারণ, যে দ্বিধার সম্মুখীন অর্জুনকে হতে হয়েছিল, সেই রকমের দ্বিধার সম্মুখীন আমাদেরও জীবনে হতে হয়। ভবিষ্যত প্রজন্মকেও হতে হবে। গীতার অমৃতবাণী তাই চিরকাল মানুষকে পথ দেখাতে থাকবে। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি যে গীতার প্রথম অধ্যায়ে পটভূমির বিবরণ রয়েছে। আর যে শাশ্বত জ্ঞানের জন্য পাঁচহাজার বছর পরেও গীতা সারা বিশ্বে এতো জনপ্রিয়, তা বিবৃত রয়েছে দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে।
হিন্দুধর্মের একাধিক শাস্ত্রের মধ্যে যদি কোন একটি গ্রন্থকে বেছে নিতে হয়, তা অবশ্যই ভগবদ্ গীতা। গীতাই হিন্দুদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ। বেদ হিন্দুধর্মের ভিত্তি। বেদের শেষ অংশ হল উপনিষদ। উপনিষদ শুধু বেদের শেষ অংশ নয়, বেদের সিদ্ধান্তও বটে। বেদের দর্শন এই উপনিষদেই নিহিত রয়েছে। এই উপনিষদেরই সারাংশ হল গীতা। বেদান্ত দর্শনে তিনটি গ্রন্থকে প্রস্থানত্রয়ী বলা হয় (প্রসঙ্গত বলে রাখি যে হিন্দু দর্শনের, যা ষড়-দর্শন নামে পরিচিত, তার ছটি শাখা রয়েছে—মীমাংসা, বেদান্ত, সাংখ্য, যোগ, ন্যায় এবং বৈশেষিক)। এই তিনটি গ্রন্থের একটি হল গীতা। আর বাকি দুটি হল উপনিষদ আর ব্রহ্মসূত্র। এই তিন গ্রন্থকে প্রস্থানত্রয়ী বলা হয় কারণ এই গ্রন্থগুলি পাঠ করলে, তার বক্তব্য সঠিক ভাবে উপলব্ধি করলে এবং জীবনে প্রয়োগ করলে মানুষের মোহ ক্ষয় হয় অর্থাৎ মানুষ মোক্ষ লাভ করে। মোক্ষলাভের অর্থ হল জন্মান্তরের চক্র থেকে—এই দুঃখময় সংসারে বারবার আসা আর যাওয়ার চক্র থেকে মুক্তি মেলে।
বাংলায় পূর্ণাঙ্গ মহাভারতের অনুবাদ অনেকেই করেছেন; কালীপ্রসন্ন সিংহ তাদের মধ্যে অন্যতম। মাত্র ২৯ বছর বয়েসে, ১৮৭০ সালে তিনি পরলোকগত হন; কিন্তু তার আগেই সম্পূর্ণ মহাভারত বাংলায় অনুবাদ করে তিনি বাঙালিকে চিরঋণী করে গেছেন। কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদিত মহাভারত বর্তমানে ‘পাবলিক ডোমেনের’ অন্তর্গত। এখানে তাঁর অনূদিত মহাভারত থেকে গীতা অংশটুকু প্রকাশ করা হল। সংস্কৃত শ্লোক নেই; শুধুমাত্র বাংলা। তাই বাঙালির পড়তে ও বুঝতে সুবিধে হবে। এখানে কালীপ্রসন্ন সিংহ যেমন বানান ব্যবহার করেছেন, তাই রাখা হল; অর্থাৎ পুরোনো বানান। যেমন, ‘ধর্ম’ লেখা হয়েছে ‘ধর্ম্ম’ হিসেবে বা ‘অর্জুন’ লেখা হয়েছে ‘অর্জ্জুন’ হিসেবে। অনেক জায়গায় অনুবাদক কিছু কঠিন বাংলা শব্দের অর্থ লিখে দিয়েছেন; এখানে তা বন্ধনীর মধ্যে রাখা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে তিনি বিস্তৃত ব্যাখ্যা করেছেন; তার সেই মন্তব্য পাদটীকায় রাখা হয়েছে। আরেকটা কথা, শেষ অধ্যায়ের শেষ অনুচ্ছেদটি আমরা বাদ দিয়েছি। এখানে গীতার মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে কয়েকটি পঙ্ক্তিতে। এটা সঞ্জয়-ধৃতরাষ্ট্র বা কৃষ্ণ-অর্জুনের কথপোকথন নয়; কথাগুলি বৈশম্পায়ন বলেছেন। এই অংশটি গীতার অন্য কোন অনুবাদে পাওয়াও যায় না। তাই অন্যান্য প্রকাশিত গীতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার জন্য সেই অংশটি বাদ দেওয়া হয়েছে।